১৯০৮ সালের ২৭ আগস্ট, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ছোট্ট শহর কুটামুন্ডিতে জন্ম নিলো একটি ছেলে। নাম রাখা হলো ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। আজ থেকে ঠিক ১১৭ বছর আগে, এই দিনেই জন্ম নিয়েছিল ছেলেটি।
কে জানতো, এই ছেলেটিই একদিন ক্রিকেটের ইতিহাসে অমর হয়ে উঠবে! এমন এক নাম, যার কাছে ক্রিকেটের পরিসংখ্যান আর রেকর্ডগুলো যেন নতজানু! এটি তার জীবনের গল্প, এক সাধারণ ছেলের অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনী।
শৈশবের ক্রিকেট: একটি গলফ বলের যাদু
ডন ব্র্যাডম্যানের শৈশব ছিল আর আট-দশটা ছেলের মতোই সাধারণ; কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসাধারণ প্রতিভা। গ্রামের বাড়ির উঠোনে, একটি গলফ বল, একটি ক্রিকেট স্টাম্প আর একটি পানির ট্যাঙ্কই ছিল তার প্রথম ক্রিকেট মাঠ।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সে গলফ বলটি দেয়ালে ছুঁড়ে মারতো, আর ফিরে আসা সেই বলটিতে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করতো। এই খেলায় তার চোখ, হাত আর মনের সমন্বয় এতটাই নিখুঁত হয়ে উঠল যে, পরবর্তী জীবনে এটিই তাকে অপ্রতিরোধ্য এক ব্যাটারে পরিণত করেছিল।
ক্রিকেট না টেনিস?
১৯২০-২১ মৌসুমে, অল্পবয়সী ডন ব্র্যাডম্যান তার মামা জর্জ হোয়াটম্যানের নেতৃত্বে স্থানীয় বোরাল দলের স্কোরার হিসেবে কাজ করেন। ১৯২০ সালের অক্টোবরে, দলে একজন খেলোয়াড় কম থাকায় ব্র্যাডম্যানকে সুযোগ দেয়া হয়। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে সেই হাতেখড়ি।
প্রথম ম্যাচেই দুই ইনিংসে ছিলেন অপরাজিত। করেন ৩৭* ও ২৯* রান করেন। ওই মৌসুমে, তার বাবা তাকে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি) পঞ্চম অ্যাশেজ টেস্ট দেখতে নিয়ে যান। ওইদিন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মুগ্ধতায় তিনি বাবাকে বলে বসেন, ‘এ মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমার তৃপ্তি হবে না।’
১৯২২ সালে ব্র্যাডম্যানের সামনে কঠিন এক প্রশ্ন হয়ে হাজির হয়- ক্রিকেট নাকি টেনিস? স্কুল ছাড়ার পর, ব্র্যাডম্যান স্থানীয় একটি রিয়েল এস্টেট এজেন্টের অধীনে কাজ শুরু করেন, যিনি তার খেলাধুলার প্রতি আগ্রহকে উৎসাহ দিয়ে প্রয়োজনীয় ছুটি দিয়ে দিতেন।
দুই বছরের জন্য ব্র্যাডম্যান ক্রিকেট ছেড়ে টেনিসে মনোনিবেশ করেন; কিন্তু ১৯২৫-২৬ মৌসুমে আবার ক্রিকেটে ফিরে আসেন আসেন। বোরাল দলের হয়ে তিনি নিয়মিত খেলা শুরু করেন। এ সময় তার অসাধারণ পারফরম্যান্স সিডনির সংবাদপত্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বেরিমা ডিস্ট্রিক্ট প্রতিযোগিতায় ম্যাটিং-ওভার-কংক্রিট পিচে খেলা বোরাল দলের হয়ে তিনি উইঙ্গেলোর বিপক্ষে ২৩৪ রান করেন, যে দলে ভবিষ্যৎ টেস্ট বোলার বিল ও’রাইলিও ছিলেন। মস ভেলের বিপক্ষে প্রতিযোগিতার ফাইনালে, টানা পাঁচ শনিবার ধরে চলা ম্যাচে, ব্র্যাডম্যান অপরাজিত ৩২০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন।
১৯২৬ সালের অস্ট্রেলিয়ার শীতকালে, অস্ট্রেলিয়ার সিনিয়র দল ইংল্যান্ড থেকে অ্যাশেজ হেরে আসার পর বেশ কয়েকজন টেস্ট খেলোয়াড় অবসর নেন। নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন নতুন প্রতিভার সন্ধান শুরু করে। ব্র্যাডম্যানের বোরালে বড় বড় স্কোরের কথা মাথায় রেখে, অ্যাসোসিয়েশন তাকে সিডনিতে একটি প্র্যাকটিস সেশনে আমন্ত্রণ জানায়।
বিজ্ঞাপন
তাকে ‘কান্ট্রি উইক’ টুর্নামেন্টে ক্রিকেট ও টেনিসে অংশ নেওয়ার জন্য ডাকা হয়; কিন্তু তার বস (সেই রিয়েল এস্টেট এজেন্ট) তাকে একটি কঠিন শর্ত দেন-কেবল এক সপ্তাহের ছুটি, তাই তাকে ক্রিকেট বা টেনিসের মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। ব্র্যাডম্যান দ্বন্দ্বে পড়ে যান। অবশেষে ক্রিকেটকেই বেছে নিলেন তিনি।
শুরু হলো ক্রিকেটে অভিযাত্রা
কান্ট্রি উইকের পারফরম্যান্সের জন্য ব্র্যাডম্যানকে ১৯২৬-২৭ মৌসুমে সিডনির সেন্ট জর্জ ক্লাবের হয়ে গ্রেড ক্রিকেট খেলার আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন তিনি। অভিষেক ম্যাচে করেন ১১০ রান। টার্ফ পিচে প্রথম সেঞ্চুরি করেন ব্র্যাডম্যান। ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি, তিনি নিউ সাউথওয়েলসের দ্বিতীয় সারির দলের হয়ে খেলেন। মৌসুমের বাকি সময়ে, তিনি প্রতি শনিবার বোরাল থেকে ১৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সিডনিতে সেন্ট জর্জের হয়ে খেলতে যেতেন।
টেস্ট ক্রিকেটে উত্থান
১৯২৮ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হলো। ব্রিসবেনে ইংল্যান্ডেরে হয়ে প্রথম ম্যাচে তিনি ব্যর্থ হলেন, মাত্র ১৮ ও ১ রান করেন। কিন্তু এই ব্যর্থতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পরের ম্যাচগুলোতে তিনি এমনভাবে রানের পাহাড় গড়তে শুরু করেন যে, ক্রিকেট দুনিয়া হতবাক হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড সফরে তিনি ৩৩৪ রানের একটি অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলেন, যা তখনকার টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা ইনিংসের মাইলফলক রচনা করে।
বডিলাইন ক্রিকেট: ক্রিকেটের মহাকাব্যিক লড়াই
ব্র্যাডম্যানের অপ্রতিরোধ্য ব্যাটিং ইংল্যান্ডের জন্য এমনই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল যে, ১৯৩২-৩৩ সালের অ্যাশেজ সিরিজে তারা ‘বডিলাইন’ কৌশল প্রয়োগ করে। ইংলিশ বোলাররা, বিশেষ করে হ্যারল্ড লারউড, ব্র্যাডম্যানকে থামাতে তার শরীর লক্ষ্য করে দ্রুতগতির বোলিং শুরু করেন। এই আক্রমণাত্মক কৌশল ক্রিকেটের ইতিহাসে বিতর্কের ঝড় তুললেও, ব্র্যাডম্যান এই সিরিজেও ৫৬.৫৭ গড়ে রান করেন, যা অন্য যে কোনো ব্যাটারের জন্য স্বপ্নের মতো ছিল।
৯৯.৯৪: এক অধরা স্বপ্ন
ব্র্যাডম্যানের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো তার টেস্ট গড় ৯৯.৯৪। ৫২ টেস্টে তিনি করেন ৬৯৯৬ রান, ২৯টি সেঞ্চুরি ও ১৩টি হাফসেঞ্চুরি। তিনি যদি তার শেষ টেস্ট ইনিংসে মাত্র ৪টি রান করতে পারতেন, তাহলে তার গড় হয়ে যেতো ১০০; কিন্তু ১৯৪৮ সালে, তার শেষ টেস্টে, ইংল্যান্ডের এরিক হলিসের বলে শূন্য রানে আউট হয়ে যান।
ব্র্যাডম্যানের এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শূন্য রানে আউট হয়ে যাওয়া দেখে ওভাল মাঠের দর্শকরা নিস্তব্ধ হয়ে যায়, আর ব্র্যাডম্যান নিজেও মাথা নিচু করে প্যাভিলিয়েনে ফিরে যান। ম্যাচের অবস্থা এমন ছিল যে, দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাট করার সুযোগ পাননি তিনি। ওই মুহূর্তটি ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি করুণ কিন্তু অবিস্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
অমর কিংবদন্তি
১৯৪৮ সালে অবসর নেওয়ার পরও ব্র্যাডম্যান ক্রিকেটের দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে কাজ করেন এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালে তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং তিনি হয়ে ওঠেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, ৯২ বছর বয়সে মারা যান ডন ব্র্যাডম্যান; কিন্তু তার কীর্তি আজও অমলিন। ক্রিকেটের যেকোনো আলোচনায়, যখনই ব্যাটিংয়ের প্রসঙ্গ ওঠে, একটি নামই সবার আগে আসে- ডন ব্র্যাডম্যান। তার ৯৯.৯৪ গড় এমন এক রেকর্ড, যা ক্রিকেটের অন্য সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যায়।
তার অসাধারণ কৃতিত্বের কথা বারবার বলার প্রয়োজন নেই। ৯৯.৯৪ সংখ্যাটা উচ্চারণ করলেই বোঝা যায়, কার কথা বলা হচ্ছে। এই অবিশ্বাস্য গড় তার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শিখর, যা ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
তিনি শুধু একজন ক্রিকেটার ছিলেন না, তিনি ছিলেন ক্রিকেটের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। যার গল্প প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।