যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা শখের বসে গ্রীষ্মকালে নিজেদের বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ করেন। এতে কিছুটা হলেও তাজা সবজি পান তাঁরা। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় দেশি সবজির বাণিজ্যিক চাষ কল্পনা করলেও বাস্তবে রূপ দিতে সাহস করেননি কেউ।
সব আশঙ্কা উপেক্ষা করে রাজধানী লন্ডনের উপকণ্ঠে তিন বাংলাদেশি যুবক—হাবিবুর রহমান, আবদুল রাজ্জাক ও ইমদাদুল বাশার মিলে বাণিজ্যিকভাবে দেশি সবজির চাষ করছেন। সবাই যখন চাকরি বা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ব্যস্ত, তখন তাঁরা গড়ে তুলেছেন সবুজ উদ্যান। নাম দিয়েছেন ‘ফ্রেশ কৃষি’। তাঁদের বাগানে লাউ, শিম, বরবটি, ডাঁটা, ধনেপাতা, শর্ষে, মেথি, মুলাশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, বেগুন, করলা, ঢ্যাঁড়স, কাঁকরোলসহ নানা শাকসবজি চাষ করছেন। এ সবজি চাষ করেই তাঁরা বিদেশের মাটিতে কোটপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

সবাই যখন চাকরি বা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ব্যস্ত, তখন তাঁরা গড়ে তুলেছেন সবুজ উদ্যান। লন্ডন, যুক্তরাজ্যছবি: সাইদুল ইসলাম
যেভাবে শুরু
হাবিবুর রহমান ও আবদুল রাজ্জাকের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায়। তাঁরা পূর্বপরিচিত। হাবিবুর ২০০৪ সাল ও রাজ্জাক ১৯৯৭ সাল থেকে ইতালিতে ছিলেন। পরে রাজ্জাক ২০১৬ সাল ও হাবিবুর ২০২০ সালে যুক্তরাজ্য গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বাসিন্দা ইমদাদুল ২০১৫ সালে শিক্ষার্থী ভিসায় যুক্তরাজ্যে যান। বর্তমানে তাঁরা তিনজনই পূর্ব লন্ডনের নিউহাম ও ইলফোর্ড এলাকায় থাকেন। তাঁদের সবার বয়স ৪০–এর নিচে।
ইতালিতে হাবিবুরের পারিবারিক সবজিবাগান ছিল। লন্ডনে আসার পর তিনি দেখেন, দোকান থেকে কেনা সবজি কয়েক দিনের পুরোনো। এতে স্বাদ কম। তরতাজা শাকসবজি খেয়ে অভ্যস্ত থাকায় এ সবজি ভালো লাগে না তাঁর। বিষয়টি নিয়ে আবদুল রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলেন হাবিবুর। ইতালির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রাজ্জাক ও ইমদাদুলকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, লন্ডনেই দেশি সবজির বাণিজ্যিক চাষ করবেন।
এরপর ২০২৩ সালে প্রায় ১ কোটি ৬৩ লাখ ৬২ হাজার টাকা (প্রায় এক লাখ পাউন্ড) বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিকভাবে সবজি চাষ শুরু করেন এই তিন উদ্যোক্তা। তিন বছরের মাথায় তা প্রায় ৯ কোটি ৮১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪০ টাকার (ছয় লাখ পাউন্ড) ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
গ্রিনহাউসে সবুজ স্বপ্ন
যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া বাংলাদেশি সবজি চাষের জন্য অনুকূল নয়। তাই গ্রিনহাউসের প্রয়োজন হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর লন্ডনের উপকণ্ঠে হারলো এলাকায় এক একর আয়তনের একটি গ্রিনহাউস ভাড়া নেন এই তিন উদ্যোক্তা।হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিটিশ শসা চাষের জন্য তৈরি এ গ্রিনহাউসকে দেশি সবজির উপযোগী করে তুলতে শুরুতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় সেচব্যবস্থা, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও যন্ত্রপাতি কেনা—সবই নতুন করে করতে হয়েছে।আবদুল রাজ্জাক যোগ করেন, ‘ইতালির তুলনায় যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া ভিন্ন। সরকারি সংস্থা থেকে কোনো প্রশিক্ষণ বা পরামর্শ পাইনি। পুরোপুরি নিজেদের জ্ঞান আর মুঠোফোনে বাংলাদেশের একজন কৃষিবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু করেছি।’
উদ্যোক্তারা বলেন, ‘ফ্রেশ কৃষি’ খামারে কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। শুধু প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করা হয়। অভিজ্ঞ শ্রমিক না পাওয়ায় তাঁরা নিজেরাই কাজ করেন।

ডাঁটা, কলমিশাকসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ করা হচ্ছে। লন্ডন, যুক্তরাজ্যছবি: সাইদুল ইসলাম
ইমদাদুল বাশার বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নিজেরাই কাজ করেছি। অভিজ্ঞ শ্রমিকের অভাব আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথম বছর লাভ না হলেও লোকসান হয়নি। পরের বছর কাছাকাছি আরেকটি দুই একর জায়গার গ্রিনহাউস ভাড়া নেওয়ার পরের বছর থেকে লাভের মুখ দেখি। চলতি মৌসুমে আমরা গত তিন মাসে ইতিমধ্যে প্রায় ৪ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার ২২৫ টাকার (২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড) সবজি বিক্রি করেছি। মৌসুম শেষ হতে হতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৮ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ৪৫০ টাকার (৫ লাখ পাউন্ড) সবজি বিক্রি করা। এখানে আমাদের ক্রেতা মূলত পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশিরা। কিন্তু এখানকার মূল চাহিদার তুলনায় আমরা ১ শতাংশও জোগান দিতে পারছি না।’
আছে চ্যালেঞ্জ
দেশি সবজি চাষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দক্ষ কর্মীর সংকট। জানাশোনার অভাবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা বা প্রশিক্ষণও পাওয়া যায় না।হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাজ্যে আসা অনেক বাংলাদেশিকে আমাদের এখানে কাজে এনেছি, কিন্তু দক্ষতার অভাবে তাঁরা বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। এ ছাড়া এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে অনূকূল প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।’এ ছাড়া কৃষিতে অনেক উপকারী পোকা থাকে, ফলে ফসলের অনেক রোগবালাই প্রাকৃতিকভাবে দমন হয়ে যায়। কিন্তু গ্রিনহাউসে সে সুযোগ না থাকায় হাত দিয়ে এগুলো করতে হয়।

গ্রিনহাউসকে দেশি সবজির উপযোগী করে তুলতে শুরুতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের। লন্ডন, যুক্তরাজ্যছবি: সাইদুল ইসলাম