ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকায় বৈধ প্রার্থী ৪৬২ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ভিপি পদে ৪৮ জন। জিএস পদে ১৯ জন ও এজিএস পদে ২৮ জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ডাকসুতে পদ আছে ২৮টি। এসব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ৫০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। যাচাই-বাছাইয়ে ৪৭টি মনোনয়নপত্র প্রাথমিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের (সিনেট ভবনে) সামনে বৃহস্পতিবার রাতে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ সময় প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ভোটার নম্বর, নাম-পরিচয় ও নিবন্ধন নম্বরে ভুল থাকাসহ বিভিন্ন কারণে ৪৭ জনের প্রার্থিতা স্থগিত হয়েছে। তাঁরা আপিল করলে যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। ২৩ আগস্ট (শনিবার) পর্যন্ত তাঁদের আপিল করার সুযোগ রয়েছে।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট বেলা একটা পর্যন্ত প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারবেন। ২৬ আগস্ট বিকেলে প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। এরপর প্রার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরু করতে পারবেন।ডাকসুতে কোন পদে কত প্রার্থী
ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে যাঁদের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৪০২ জন ছাত্র ও ছাত্রী ৬০ জন। ডাকসুর ভিপি (সহসভাপতি) পদে ৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ছাত্র ৪৩ জন আর ছাত্রী ৫ জন। জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে ১৯ প্রার্থীর মধ্যে শুধু একজন ছাত্রী। এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদে ২৮ জন প্রার্থীর মধ্যে চারজন ছাত্রী, বাকিরা ছাত্র।
ডাকসুর সম্পাদকীয় পদগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৫ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১১ জন, ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে ৯ জন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৩ জন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ১১ জন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ১৫ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ৯ জন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১৩ জন, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ১১ জন, কমনরুম, পাঠকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ১১ জন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১৫ জন এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদে ১৯ জনের মনোনয়নপত্র প্রাথমিকভাবে বৈধ হয়েছে।
এ ছাড়া ডাকসুর ১৩টি সদস্য পদের জন্য ২১৫ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৯১ জন ছাত্র আর ২৪ জন ছাত্রী।
হল সংসদে প্রার্থী হাজারের ওপর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন হল আছে ১৮টি। প্রতিটি হল সংসদে ভিপি, জিএসসহ পদ আছে ১৩টি। সব হল মিলিয়ে মোট পদ রয়েছে ২৩৪টি। এর বিপরীতে ১ হাজার ১০৮ জন শিক্ষার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। শুধু ফজলুল হক মুসলিম হলে একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
ছাত্রীদের পাঁচটি হলে কোথাও মোট পদের দ্বিগুণের বেশি, কোথাও তিন গুণের বেশি ছাত্রী প্রার্থী হয়েছেন। কবি সুফিয়া কামাল হল সংসদের ১৩টি পদে প্রার্থী হয়েছেন ৪০ জন, রোকেয়া হলে ৪৫ জন, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৩১ জন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩৬ জন আর শামসুন নাহার হল সংসদে প্রার্থী হয়েছেন ৩৬ জন ছাত্রী।
শামসুন নাহার হল এবং ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদে একজন করে প্রার্থী রয়েছেন। সে ক্ষেত্রে ওই দুই হলে বহিরঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদে ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না।
প্রকাশিত প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, ছাত্রদের জগন্নাথ হলে ১৩ পদে প্রার্থী ৫৯ জন, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৬৪ জন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৬২ জন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলে ৭০ জন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৭৮ জন, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৮১ জন, বিজয় একাত্তর হলে ৭৭ জন, কবি জসীমউদ্দীন হলে ৬৯ জন, স্যার এ এফ রহমান হলে ৬৭ জন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৬৫ জন, শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৬৮ জন, মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ৭৯ জন এবং অমর একুশে হল সংসদের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ৮১ জন।
ক্যাম্পাসে নির্বাচনের আমেজ
১৯৯০ সালের নির্বাচনে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদে জিএস পদে নির্বাচিত হন মঞ্জুর এলাহী। তিনি এখন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁকে ডাকসু ভবনের নিচতলায় দেখা যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন চলছে। তাই হঠাৎ করেই ক্যাম্পাসে আসতে ইচ্ছা হলো।
মঞ্জুর এলাহী বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত হওয়া দরকার। এই নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়।
ডাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘জুলাই স্মৃতি সংগ্রহশালা’। সেখানে দায়িত্বরত কর্মচারী মো. রাকিব বলেন, ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনেকে ডাকসু ভবনে আসছেন। তাঁদের বেশির ভাগই আগে ছাত্ররাজনীতি করতেন।
ডাকসু ভবন থেকে বেরিয়ে মধুর ক্যানটিনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের প্রার্থী, নেতা-কর্মী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিচ্ছেন। আলোচনার মূল বিষয় ডাকসু নির্বাচন। ডাকসুতে কোন পদে কে এগিয়ে আছেন, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন তাঁরা।ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন
ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ (গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ), ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট (ইসলামী ছাত্রশিবির), প্রতিরোধ পর্ষদ (বামপন্থী সাত ছাত্রসংগঠনের যৌথ প্যানেল), সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ (মাহিন সরকার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র প্যানেল), ডাকসু ফর চেঞ্জ, ভোট ফর চেঞ্জ (ছাত্র অধিকার পরিষদ), ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ (বামপন্থী তিন সংগঠনের যৌথ প্যানেল), সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ (ইসলামী ছাত্র আন্দোলন) ও ছাত্র ফেডারেশন ইতিমধ্যে ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল ঘোষণা করেছে।
ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থীরা বৃহস্পতিবার দুপুরে মধুর ক্যানটিনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি চিরতরে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি থেকে মূলোৎপাটন করা হবে। ক্যানটিনে ফাও খাওয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক যে অপসংস্কৃতিগুলো ছিল, সেসব অপসংস্কৃতি চিরতরে মূলোৎপাটন করা হবে। শিক্ষার্থীরা যেন মানসিক প্রশান্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন, সে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও নজর থাকবে তাঁদের।
দখল-সন্ত্রাস হবে কি না, নির্ধারণ করবে ডাকসু
বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সংবাদ সম্মেলন করে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামে স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা করেন উমামা ফাতেমা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক এই মুখপাত্র নিজ প্যানেল থেকে ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছেন। এই প্যানেল থেকে জিএস পদে লড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া। আর এজিএস পদে প্রার্থী হয়েছেন জাহেদ আহমদ।
সংবাদ সম্মেলনে উমামা ফাতেমা বলেন, আগামী দিনে হলগুলো দখল হবে কি না—এই ডাকসুর মাধ্যমে তা নিশ্চিত হবে। ক্যাম্পাস আবার একটা সন্ত্রাসের মুখোমুখি হবে কি না—সেটিও এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।